উত্তরা থেকে কামরুজ্জামান
বিশ্ব সমাজব্যবস্থায় বিয়ে একটি গুরুত্বপূর্ণ অধ্যায় এবং একটি পবিত্র বন্ধনও বটে। বিয়ে নারী-পুরুষের সুখশান্তি ও প্রেম-ভালোবাসার মধুরতম বন্ধন সৃষ্টি ছাড়াও মানব বংশের স্থায়িত্ব ও সভ্যতার বিকাশ ঘটায়। তবে বাল্যবিবাহ তার বিপরীত। বিশেষজ্ঞদের মতে, বাল্যবিবাহ হলো অপ্রাপ্তবয়স্ক ব্যক্তির আনুষ্ঠানিক অথবা অনানুষ্ঠানিক বিবাহ। বাল্য বিবাহ একটি দেশ ও জাতিকে অন্ধকার ও পঙ্গুত্বের দিকে ঠেলে দেয়। বর্তমানে বাল্যবিবাহ জাতির জন্য একটি বড় সামাজিক সমস্যা হয়ে দাড়িয়েছে। বাংলাদেশে বাল্যবিবাহ নিরোধ আইন ২০১৭ অনুযায়ী ১৮ বছরের কম বয়সী নারী এবং ২১ বছরের কম বয়সী পুরুষের বিয়েকে বাল্যবিবাহ ধরা হয়। আর এ ধরনের বিয়ে সম্পূর্ণ নিষিদ্ধ। বাল্যবিবাহের কারণে নারীর প্রতি সহিংসতা, মাতৃমৃত্যুর ঝুঁকি, অপরিণত গর্ভধারণ, প্রসবকালীন শিশুর মৃত্যুঝুঁকি, প্রজনন স্বাস্থ্য সমস্যা, নারীশিক্ষার হার হ্রাস, স্কুল থেকে ঝরে পড়ার হার বৃদ্ধি, নারীদের অর্থনৈতিকভাবে স্বাবলম্বী হওয়ার ক্ষমতা ও সুযোগ কমে যাওয়াসহ নানা রকম নেতিবাচক প্রভাব পড়ার আশঙ্কা থাকে। পৃথিবীর যে কটি দেশে বাল্যবিবাহের প্রবণতা বেশি তার মধ্যে বাংলাদেশ অন্যতম। তাই বাল্যবিবাহ প্রতিরোধে সরকার কঠোর আইন প্রনয়নের পাশাপাশি নানামুখী পদক্ষেপ গ্রহণ করেছে। একই সাথে বাল্যবিবাহমুক্ত রাষ্ট্র গড়তে সরকারি ও বেসরকারি বিভিন্ন উন্নয়ন সংস্থা এবং সামাজিক সংগঠন প্রান্তিক জনগোষ্ঠিকে সম্পৃক্ত করে সচেতনতামূলক কার্যক্রম চালিয়ে যাচ্ছে।
বাংলাদেশে বাল্যবিবাহ নিরোধ আইন-২০১৭ অনুযায়ী বাল্যবিবাহের সাথে যুক্ত তিন ধরনের ব্যক্তি অপরাধী বলে গণ্য হবেন, বিবাহ সম্পন্নকারী প্রাপ্তবয়স্ক ব্যক্তি (স্বামী), পিতা-মাতা বা অভিভাবক যারা বাল্যবিবাহে সম্মতি দেন বা এতে সহায়তা করেন, এবং যারা বিয়েটি সম্পন্ন হওয়ার ক্ষেত্রে নিজেরা জড়িত ছিলেন (যেমন কাজী বা সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তা)। এছাড়া, যদি কোনো অপ্রাপ্তবয়স্ক ব্যক্তি নিজেরা বাল্যবিবাহের সাথে জড়িত থাকে, তারাও অপরাধী বলে বিবেচিত হতে পারে। আর এ ক্ষেত্রে অপরাধীদের শাস্তি স্বরূপ সর্বোচ্চ দুই বছর কারাদন্ড বা এক লাখ টাকা জরিমানা অথবা উভয় দন্ডে দন্ডিতের বিধান রাখা হয়েছে।
এতদসত্ত্বেও, দেশের প্রত্যন্ত অঞ্চলের সাথে পাল্লা দিয়ে খোদ রাজধানীতেও ঘটছে বাল্যবিবাহের মতো ঘটনা। কিছু কিছু ক্ষেত্রে পরিবার বা নিকটাত্মীয়দের দ্বারাও শারীরিক ও মানসিক হেনস্থার শিকার হচ্ছে মেয়ে শিশুরা। সম্প্রতি রাজধানীর উত্তরার দক্ষিণখান থানার মুন্সিমার্কেট এলাকার বটতলা রোডে জনৈক সোহাগ মিয়ার বাড়িতে অপ্রাপ্ত বয়স্ক শিশু জান্নাতের সাথে শাকিলের বিয়ে সম্পন্ন হয়। এলাকাবাসী জানান, জান্নাতের বয়স ১৩ কিংবা ১৪ বছর এবং শাকিলের বয়স ২১ কিংবা ২২ বছর হবে। জান্নাতের মা বর্তমানে জান্নাতের কাছে না থাকায় মামা কাশেম ও নানা কালামের পরিবারেই বড় হচ্ছিল জান্নাত। জান্নাতের মা মারা গেছে বলে তার নানার পরিবার জানালেও এলাকাবাসী বলছে ভিন্ন কথা। জান্নাতের মা অন্যত্র বিয়ে করে ঘর-সংসার পেতেছেন বলেও কানাঘুসা চলছে এলাকায়। পুরো বিষয়টি জানতে গেল ২৫ সেপ্টেম্বর ২০২৫ তারিখ বৃহস্পতিবার সদ্য বিয়ে হওয়া শাকিল-জান্নাতের দক্ষিণখান থানার মোল্লারটেকের ভাড়া বাসায় যান দৈনিক জনতার উত্তরা প্রতিনিধি। সেখানে গিয়ে কনের বয়স সম্পের্কে জানতে চাইলে নববিবাহিতা জান্নাত জানায়, তার বয়স ১৫ বছর এবং জন্ম নিবন্ধনের মাধ্যমে তার মামা কাশেম ১৬ সেপ্টেম্বর ২০২৫ তারিখ মঙ্গলবার কাজীকে বাসায় এনে তাদের কোর্ট কাবিন করিয়েছেন। এ ব্যাপারে শাকিলের সাথে কথা বলতে চাইলে তাকে পাওয়া যায়নি। শাকিল ব্যবসার কাজে অন্যত্র আছেন এবং তার মোবাইল ফোনও নষ্ট হয়ে গেছে বলে জানায়, শাকিলের পরিবার। তবে শাকিলের বোন আফরিন সুলতানা জানান, তারা এই অপ্রাপ্ত বয়স্ক জান্নাতকে তাদের ফ্যামিলিতে বউ করে আনতে চাননি। আফরিন সুলতানার পিতা আব্দুল হামিদ এবং মাতাও তার কথায় সায় দেন। শাকিলের মা-বাবা ও বোনের দাবি- জান্নাতের মামা কাশেম ও নানা কালাম (ভাঙ্গারী ব্যবসায়ী) এক প্রকার জোড় করেই ৩ লাখ টাকা দেনমোহর ধার্য করে শাকিল-জান্নাতের কাবিন করিয়েছেন। এদিকে, নাম প্রকাশ না করার শর্তে স্থানীয় কিছু মানুষ জানান, মা না থাকায় নানা ও মামার কাছে মানুষ হওয়ার সূত্রে ছোট বেলা থেকেই শিশু জান্নাতকে মানসিক টর্চার করতো মামা কাশেম ও নানা কালামসহ তার পরিবার। এমনকি আরও আগ থেকেই জান্নাতকে চুল ফ্যাক্টরিতে শিশু শ্রমিকের কাজ করতে বাধ্য করেছে তারা। বিষয়টি অনেকটাই পরিষ্কার হয়ে যায় শাকিলের বোন আফরিন সুলতানার কথায়। তিনি জান্নাতের সামনেই জান্নাতকে দিয়ে চুল ফ্যাক্টরিতে কাজ করানোসহ তার নানাবাড়ি কর্তৃক মানুষিক ও শারীরিক হেনস্থার কথা তুলে ধরেন এবং জান্নাতকেও অনুরোধ করেন সাংবাদিকের সামনে খুলে বলতে। এ বিষয়ে জান্নাতের কাছে জানতে চাইলে তিনি নীরব থেকে মাটির দিকে তাকিয়ে ছিলেন। কোন ভাষাই বলতে পারেননি মুখে।
পরে পুরো বিষয়টি জানতে জান্নাতের মামা কাশেমকে মোবাইল ফোনে ডাকা হয় শাকিলের ভাড়া বাসায়। কিছুক্ষণ পর ২-৩ জন যুবক ও বেশ কয়েকজন মহিলা সাথে নিয়ে হুড়মুড় করে এসে শাকিলের ঘরে ঢোকেন কাশেম। সাংবাদিককে দেখেই তার চেহরা যেন অগ্নিবর্ণ ধারণ করে। কয়জন সাংবাদিক এসেছে? মাত্র একজন? এভাবেই নানা উপহাস মূলক কথা বলতে থাকেন সাংবাদিককে উদ্দেশ্য করে। এক পর্যায়ে তিনি বলেন, তারা যা কিছু করেছেন কাজীর পরামর্শ নিয়েই করেছেন। তার কাছে জান্নাত-শাকিলের বিয়ের কি কি কাগজপত্র আছে জানতে চাইলে কাশেম জানান, একজন ভালো কাজী দিয়ে শাকিল-জান্নাতের বিয়ের কাবিন রেজিস্ট্রি করানো হয়েছে এবং ঐ কাবিনের নকল তার কাছে আছে। এনআইডি কার্ড বা প্রাপ্ত বয়স্ক হওয়ার আগেই কাজী কিভাবে কাবিন রেজিস্ট্রি করলো জানতে চাওয়াসহ কাবিনের নকলের কপি দেখতে চাইলে কাশেম আরও রাগান্বিত হন। একপর্যায়ে তার সাথে থাকা লোকজন নিয়ে মব সৃষ্টি করার চেষ্টা করে কাশেম। বিষয়টি বুঝতে পেরে বিশেষ কৌশলে দ্রুত শাকিলের ভাড়া বাসা থেকে প্রস্থান করেন ঐ সাংবাদিক। পরে একই দিন সন্ধ্যায় কাজীর ফোন নাম্বার ম্যানেজ করে তাকে ফোন করলে তার নাম ওমর ফারুক এবং দক্ষিণখান থানার কাজী আব্দুল আওয়ালের সহকারী বলে তিনি নিজেকে পরিচয় দেন। একই সাথে দক্ষিণখান থানার ৫০নং ওয়ার্ডের আযমপুর রেল গেটের অদুরে ১০নং রোডের কাজী অফিসে বসেন বলেও জানান তিনি। ফোনে তিনি এও বলেন, শাকিল-জান্নাতের বিয়ের কোন কাবিন রেজিস্ট্রি করা হয়নি। বিয়ের অনুষ্ঠানে তাকে দাওয়াত দিলে এক আইনজীবীর দেওয়া একটি হলফ নামার পরিপ্রেক্ষিতে তিনি শুধু বিয়ে পড়িয়েছেন। কাবিন রেজিস্ট্রি না হলে কাশেমকে কিভাবে কাবিনের নকলের কপি দিলেন জানতে চাইলে নকল দেওয়ার বিষয়টিও তিনি অস্বীকার করেন এবং সাংবাদিককে তার অফিসে এসে কথা বলতে বলেন।
পরবর্তীতে ২৭ সেপ্টেম্বর ২০২৫ তারিখ শনিবার কাজী ওমর ফারুকের ১০ নং রোডের অফিসে এসে তার কাছে শাকিল-জান্নাতের বিয়ের কোন ডকুমেন্টস বা যে হলফ নামার প্রেক্ষিতে তিনি বিয়ে পড়িয়েছেন বলে স্বীকারোক্তি দিয়েছেন তার কপি দেখতে চাইলে তিনি তা দেখাতে পারেননি। এমনকি হলফ নামাটিতে কোন আইনজীবী স্বাক্ষর করেছেন তার সম্পর্কেও কোন তথ্য দিতে পারেননি ওমর ফারুক। এর পর থেকে গণমাধ্যমকর্মী পরিচয় দিয়ে বিভিন্ন ব্যক্তি এই প্রতিবেদককে ম্যানেজ করার চেষ্টা করছে।
এদিকে, এলাকার কিছু গণমান্য ব্যক্তি জানান, টাকার বিনিময়ে এরকম দু’একটা হলফনামা কাজীরা নিজেরাই তৈরি করে থাকেন। এতে সুবিধা হলো ছেলে-মেয়ে বা তাদের গার্ডিয়ান কাউকেই কোন উকিলের দ্বারস্থ হতে হয় না। কাজীদেরও ব্যবসা জমজমাট। একের ভেতর তিন লাভ- বিয়ের ফি, হলফনামা বানানোর খরচ সেই সাথে এত বড় অসাধ্য সাধন করে দিয়েছেন তার একটা হাদিয়াতো আছেই।
২০১৮ সালের পর থেকে বাংলাদেশ সরকার বিভিন্ন সময় বিভিন্ন উপজেলাকে বাল্যবিবাহমুক্ত উপজেলা ঘোষণা করলেও কাশেমদের মতো কিছু নিকট আত্মীয়দের হস্তক্ষেপ এবং ওমর ফারুকদের মতো সার্থান্বেসী কিছু কাজীদের কারনেই হয়তো থমকে যাচ্ছে বাল্যবিবাহ নিরোধ প্রক্রিয়া। প্রশাসনের নিরবতাকেও এর জন্য কম দায়ী করছেন কেউ কেউ।
পাঠক তাহলে এখন প্রশ্ন হলো-সরকারি ও বেসরকারি সংগঠনগুলোর এত এত চেষ্টা ও খরচা কি তাহলে সবই বিফলে যাবে? নাকি কাশেম ও ওমর ফারুকদের মতো মূল হোতাদের আইনের আওতায়ে এনে সঠিক বিচার করে দেশের আপামার জনগণকে বোঝানো সম্ভব যে, আইনের প্রয়োগ এখনও বাকি আছে?
নিউজটি আপডেট করেছেন : Dainik Janata
